দান বা ঋণ গ্রহণ সম্পর্কে আয়কর অধ্যাদেশের সংশোধিত বিধান

আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান অনুযায়ী কোন কর বছরে এক বা একাধিক ব্যক্তির নিকট হতে নগদে গৃহিত ঋণ বা দানের পরিমাণ ৫ লক্ষ টাকার বেশি হলে সমুদয় ঋণ বা দান গ্রহীতার অন্যান্য সূত্রের আয় হিসাবে গণ্য হয়। অর্থ আইন, ২০১৭ এর মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর পর একটি নতুন প্রোভাইসো সংযোজন করা হয়েছে। নতুন প্রোভাইসোর বিধান মোতাবেক (ক) স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর নিকট হতে, (খ) স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর নিকট হতে, এবং (গ) সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার নিকট ঋণ বা দান গ্রহণে যদি ব্যাংকিং বা আনুষ্ঠানিক মাধ্যম জড়িত থাকে তাহলে উক্ত ঋণ বা দানের ক্ষেত্রে ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান প্রযোজ্য হবে না।
ব্যাংকিং মাধ্যম (banking channel) জড়িত থাকা বলতে বুঝাবে প্রদানকারী ও গ্রহণকারীর মধ্যে কমপক্ষে যে কোন একজনের ব্যাংক হিসাবে দান বা ঋণ প্রদান/গ্রহণের প্রমাণ থাকবে।

উদাহরণ-১
জনাব আরিফ আহমেদ তার আয়কর রিটার্নে প্রদর্শিত টাকায় ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে স্ত্রীর নামে ১০ লক্ষ টাকার এফডিআর হিসাব খুলেছেন। মিসেস আরিফ তার ২০১৭-১৮ কর বছরের জন্য দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে এফডিআরে বিনিয়োগকে সম্পদ হিসেবে ও এর উৎস হিসাবে স্বামীর নিকট হতে দান প্রাপ্তি প্রদর্শন করেছেন এবং এর স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় দলিলাদি সংযুক্ত করেছেন।
এক্ষেত্রে এফডিআরে বিনিয়োগের অর্থ জনাব আরিফের নিকট হতে নগদে পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে এটি একটি নগদ দান। উক্ত দান জনাব আরিফ ও মিসেস আরিফ উভয়ের ব্যাংক হিসাবে প্রতিফলিত না হলেও দানের অর্থে সরাসরি মিসেস আরিফের নামে ব্যাংকে এফডিআর হিসাব খোলা হয়েছে বিধায় এক্ষেত্রে ব্যাংকিং মাধ্যম জড়িত বলে বিবেচিত হবে। তাই, মিসেস আরিফের এ দান গ্রহণের ক্ষেত্রে ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান প্রযোজ্য হবে না।
উদাহরণ-২
মিজ্ নায়লা চৌধুরী তার স্বামীকে ঋণ প্রদান বাবদ তার স্বামীর ব্যাংক হিসাবে ১০ লক্ষ টাকা জমা করেছেন। মিজ্ চৌধুরী ও তার স্বামীর আয়কর নথিতে বিষয়টির প্রতিফলন আছে এবং ঋণের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় দলিলাদি সংযুক্ত/দাখিল করা হয়েছে।
এ ঋণ প্রদানে ব্যাংকিং মাধ্যম জড়িত বিধায় এক্ষেত্রে ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান প্রযোজ্য হবে না।
নগদ দান বা ঋণের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক মাধ্যম (Formal Channel) জড়িত বলতে বুঝাবে দান বা ঋণ দাতার নগদ অর্থ সরাসরি দান/ঋণ গ্রহিতার নামে কোন আনুষ্ঠানিক (Formal) সম্পদ অর্জনে ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে নগদ দান/ঋণের অর্থ কোন সম্পদ অর্জনে ব্যবহৃত হয়েছে তাও সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। কেবল অংগীকারনামা বা নোটোরি পাবলিকের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে দাতা ও গ্রহীতার সম্পদ বিবরণীতে উক্ত অর্থের প্রতিফলন থাকাটা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে না। উদাহরণ স্বরূপ, নগদ দান গ্রহন করে তা নগদ তহবিল হিসাবে দান গ্রহিতার সম্পদ বিবরণীতে প্রদর্শন করা হলে উক্ত দানের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক মাধ্যম জড়িত নয় বলে বিবেচিত হবে এবং দানটির ক্ষেত্রে ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান প্রযোজ্য হবে।
উদাহরণ-৩
করদাতা জনাব সাব্বির হায়দার খান ২০১৭-১৮ কর বছরে তার সম্পদ পরিবৃদ্ধির উৎস হিসাবে পিতার নিকট হতে ৩০ লক্ষ টাকা নগদ দান প্রাপ্তি প্রদর্শন করেছেন, যা করদাতা ও তার পিতা উভয়ের কর নথিতে প্রদর্শিত আছে। করদাতার পিতার দানের স্বপক্ষে একটি হলফনামাও প্রদান করেছেন।
এক্ষেত্রে নগদ দানের অর্থ কোন সুনির্দিষ্ট দৃশ্যমান আনুষ্ঠানিক সম্পদ অর্জনে ব্যবহৃত হয়েছে মর্মে প্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি। বরং সম্পদ বিবরণী বিশ্লেষণের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট তহবিল ঘাটতির উৎস হিসাবে নগদ দান প্রদর্শিত হয়েছে। তাই উক্ত দানে আনুষ্ঠানিক মাধ্যম (Formal Channel) জড়িত নয় বলে বিবেচিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান প্রযোজ্য হবে।
উদাহরণ-৪
একজন করদাতা তার পেনশনের টাকা থেকে ছেলের নামে ২০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেছেন, যা দালিলিক প্রমাণসহ ছেলের আয়কর নথিতে প্রদর্শন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নগদ দানের অর্থ ব্যবহার করে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা হয়েছে, যা একটি দৃশ্যমান আনুষ্ঠানিক সম্পদ। ফলে উক্ত দানে আনুষ্ঠানিক মাধ্যম (Formal Channel) জড়িত বলে বিবেচিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান প্রযোজ্য হবে না।
উদাহরণ-৫
করদাতা জনাব বজলুল হায়দার ২০১৭-১৮ কর বছরে একটি এপার্টমেন্ট ক্রয়ে ৮০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ প্রদর্শন করেন, যার মধ্যে ৫০ লক্ষ টাকা করদাতার মায়ের নামে পরিচালিত এফডিআর (যা ২০১৬-১৭ কর বছরে করদাতার মায়ের আয়কর নথিতে প্রদর্শিত) নগদায়ন পূর্বক সরাসরি ডেভেলপারকে পরিশোধ করা হয়েছে। করদাতা ও তার মায়ের নথিতে ৫০ লক্ষ টাকা নগদ দান হিসাবে প্রদর্শন করা হয়েছে। এপার্টমেন্ট ক্রয় এবং এফডিআর নগদায়নের প্রমাণ ও করদাতার নথিতে প্রদর্শন করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে নগদ দানের অর্থ দৃশ্যমান আনুষ্ঠানিক সম্পদ অর্জনে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে, উক্ত দানে আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে (Formal Channel) জড়িত বলে বিবেচিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান প্রযোজ্য হবে না।
উল্লেখ্য, ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধানে প্রযোজ্যতা এবং দান/ঋণের যাছাইযোগ্যতা (Verifiability) দুটি আলাদা বিষয়। কোন নগদ ঋণ বা দানের ক্ষেত্রে ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধানের প্রযোজ্যতা না থাকলেও সে ঋণ মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে উপ কর কমিশনার দান বা ঋণ প্রদানকারীর সামর্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি যথারীতি পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন।
ধরা যাক, একজন করদাতা তার সম্পদ বিবরণীতে পিতার নিকট হতে ১০ লক্ষ টাকা নগদ দান গ্রহণ প্রদর্শন করেছেন যাতে ব্যাংকিং বা আনুষ্ঠানিক (Formal) মাধ্যম জড়িত নেই। এক্ষেত্রে যদি দানের বিষয়টি করদাতার পিতার আয়কর নথির তথ্য, সামর্থ্য বা অন্য কোন সূত্রে যাচাইযোগ্যও হয় তবু উক্ত দান ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর বিধান অনুযায়ী করদাতার অন্যান্য সূত্রের আয় হিসাবে গণ্য হবে।
অপর দিকে ধরা যাক, একজন করদাতার পিতা নিজের টাকায় সরাসরি ব্যাংকে করদাতার নামে ৫০ লক্ষ টাকার এফডিয়ার হিসাব খুলেছেন, যা করদাতা তার সংশ্লিষ্ট কর বছরে পিতার নিকট দান প্রাপ্তি হিসাবে প্রদর্শন করেছেন। এ ক্ষেত্রে উক্ত দানে ব্যাংকিং মাধ্যম জড়িত বিধায় ধারা ১৯ এর উপধারা (২৮) এর প্রযোজ্যতা থাকবে না। তবে উপ কর কমিশনার এফডিআরে বিনিয়োগের উৎস হিসাবে দান মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে পিতার সামর্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন।
পরিবর্তিত এ বিধান ২০১৭-১৮ কর বছর থেকে কার্যকর হচ্ছে।

তথ্যসূত্র: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড

No comments:

Post a Comment

Pages