দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের পাশাপাশি বাড়ছে চাকরিজীবীর সংখ্যা। যাদের অনেকেই কর দিয়ে থাকেন। সেই কথা মাথায় রেখেই এই বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নতুন একটি রিটার্ন ফর্ম ‘আইটি-১১ঙ’ চালু করেছে যা অনেক সহজ।
এই নতুন রিটার্ন ফর্ম মাত্র তিন পৃষ্ঠার। আগে যাদের বেতন থেকে আয় ছিল তাদেরকে মূল রিটার্নের সঙ্গে তফসিল ২৪এ জমা দিতে হতো। কিন্তু নতুন রিটার্ন ফর্মে সে ধরনের কোনো ছাপানো ফর্ম নেই। সাদা কাগজে আপনার বেতন থেকে করযোগ্য আয় গণনার হিসেব জমা দিতে হবে।
নিচে আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে এই গণনা করবো। যেহেতু অনেক সংখ্যা ব্যবহার করা হবে তাই হাঁপিয়ে না উঠে ধৈর্য নিয়ে যদি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পারেন তাহলে নিজেই বের করতে পারবেন আপনার করযোগ্য আয়।
তাহলে চলুন শুরু করি।
ধরা যাক করিম একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে নিচের সুবিধাগুলো পেয়ে থাকেন।
০১। মূল বেতন মাসিক ৮০,০০০ টাকা।
০২। বাড়ি ভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৫০% অর্থাৎ ৪০,০০০ টাকা (মাসিক)।
০৩। যাতায়াত ভাতা মাসিক ৫,০০০ টাকা।
০৪। চিকিৎসা ভাতা মাসিক ৫,০০০ টাকা।
০৫। প্রভিডেন্ট ফান্ডে মূল বেতনের ১০% করিম এবং তার প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকেন।
০৬। উৎসব ভাতা মাসিক মূল বেতনের সমান দুইটা।
জেনে গেলাম তিনি চাকরি করে সারা বছরে কি পরিমাণ আয় করেন। এবার চলুন তার করযোগ্য আয় কত তা ধাপে ধাপে জেনে নেই।
মূল বেতন
মূল বেতন সম্পূর্ণটাই করযোগ্য আয়। আপনি যতই মূল বেতন হিসেবে প্রতিষ্ঠান থেকে পান না কেনো তার সবটুকুই আপনার করযোগ্য আয়ের সঙ্গে যোগ হবে।
তাহলে মাসিক ভিত্তিতে ১২ মাসে মোট ৯,৬০,০০০ (৮০,০০০X১২) টাকা মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে।
বাড়ি ভাড়া ভাতা
নগদ বাড়ি ভাড়া ভাতার ক্ষেত্রে মূল বেতনের ৫০% অথবা মাসিক ২৫ হাজার টাকা, এই দুইটা অংকের মধ্যে যেটা ছোট সেটা বাদ যাবে।
যেহেতু করিম মূল বেতনের ৫০% অর্থাৎ ৪০,০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া ভাতা পাচ্ছেন তাই সেটা থেকে ২৫,০০০ টাকা বাদ দিয়ে থাকবে মাসিক ১৫,০০০ টাকা।
এই টাকা তার মোট করযোগ্য আয়ের সঙ্গে যোগ হবে। তাহলে ১২ মাসে মোট বাড়ি ভাড়া ভাতা থেকে যোগ হবে ১,৮০,০০০ টাকা।
যাতায়াত ভাতা
যাতায়াত ভাতা নগদ পেলে বাৎসরিক ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত কর মওকুফ পাওয়া যাবে। করিম মাসিক ৫,০০০ টাকা করে পাচ্ছেন, বছরে ৬০,০০০ টাকা।
তাহলে বছরে তার মোট ৩০,০০০ টাকা মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে।
চিকিৎসা ভাতা
মূল বেতনের ১০% অথবা প্রকৃত খরচ তার চিকিৎসা ভাতা থেকে বাদ গিয়ে বাকিটা মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে।
মাসে পাচ্ছেন ৫,০০০। তার মাসিক মূল বেতনের ১০% হলো ৮,০০০ টাকা। যেহেতু তার ভাতা ছাড়ের অংক থেকে বেশি তাই এখানে কোনো টাকা তার মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে না।
প্রভিডেন্ট ফান্ড
প্রতিষ্ঠান থেকে যে অংশটা পাবেন সেটা সবটাই তার মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে।
তাহলে তার মূল বেতনের ১০% অর্থাৎ ৮,০০০ টাকা করে বছরে ৯৬,০০০ টাকা তার মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে।
উৎসব ভাতা
উৎসব ভাতা সম্পূর্ণ অংশই মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হয়।
যেহেতু করিম দুইটা মাসিক মূল বেতনের সমান উৎসব ভাতা পান তাই সম্পূর্ণটাই অর্থাৎ ১,৬০,০০০ টাকা পুরোটাই তার মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে।
আমাদের ধাপে ধাপে তার কোন খাতে কত মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে তা পেয়ে গেছি।
০১ নাম্বার সিরিয়াল থেকে ০৬ নাম্বার সিরিয়াল পর্যন্ত গণনা করা টাকাগুলো যোগ করলে তার মোট আয়ের পরিমাণ হয় ১৪,২৬,০০০ টাকা।
এই টাকার উপর তাকে আয়কর দিতে হবে।
মোট আয়কর কত?
ধরে নিলাম তিনি ২,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয়কর ছাড় পাবেন।
তাহলে তার মোট আয়করের পরিমাণ হবে:
প্রথম ২,৫০,০০০ টাকার উপর ০%
পরবর্তি ৪,০০,০০০ টাকার উপর ১০%= ৪০,০০০ টাকা
পরবর্তি ৫,০০,০০০ টাকার উপর ১৫%= ৭৫,০০০ টাকা।
অবশিষ্ট ২,৭৬,০০০ টাকার উপর ২০%= ৫৫,২০০ টাকা।
তাহলে তার মোট আয়করের পরিমাণ হল ১,৭০,২০০ টাকা।
মোট করের পরিমাণ দেখে ভয় পেয়ে গেছেন!
তবে সঠিকভাবে ট্যাক্স প্যানিং করে এই আয়করের পরিমাণ প্রায় অর্ধেক কমিয়ে আনা যায়। তার জন্য সঠিক খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।
ধরে নিলাম করিম সঠিক খাতে বিনিয়োগ করেছেন।
কত বিনিয়োগ সুবিধা পাবেন?
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-তে তিনটি অংকের কথা বলা হয়েছে।
এই তিন অংকের মধ্যে যেটি কম সেটাই তিনি বিনিয়োগ হিসেবে দেখাতে পারবেন।
তবে যতই বিনিয়োগ করুন না কেনো তার মোট আয়ের ২৫% এর বেশি তিনি বিনিয়োগ সুবিধা পাবেন না।
তাই আমরা এখানে ধরে নিলাম তিনি তার মোট আয়ের অর্থাৎ ১৪,২৬,০০০ টাকার ২৫% বিনিয়োগ সুবিধাই পাবেন।
তাহলে তার মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ৩,৫৬,৫০০।
এই টাকার উপর তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত হারে আয়কর রেয়াত পাবেন।
কত আয়কর রেয়াত পাবেন?
তিনটি হারে তিনি বিনিয়োগকৃত টাকার উপর আয়কর রেয়াত পাবেন।
প্রথম ২,৫০,০০০ টাকার উপর ১৫%।
পরবর্তী ২,০০,০০০ টাকার উপর ১২% এবং
অবশিষ্ট বিনিয়োগের উপর ১০%।
চলুনে জেনে নেই করিম কত টাকা আয়কর রেয়াত পাবেন।
প্রথম ২,৫০,০০০ টাকার উপর ১৫% অর্থাৎ ৩৭,৫০০ টাকা।
তাহলে বাকি থাকল আর ১,০৬,৫০০ টাকা। এই টাকার উপর পাবে ১২% হারে অর্থাৎ ১২,৭৮০।
তাহলে তার মোট আয়কর রেয়াতের পরিমাণ হল ৫০,২৮০ টাকা।
উৎসে কর কর্তনের কথা শুনেছেন যেটা মোট করদায় থেকে বাদ যায়। ধরে নিলাম সেটা মাসিক ৫,০০০ টাকা।
যেহেতু প্রতি মাসে ৫,০০০ টাকা ইতোমধ্যেই দিয়ে দিয়েছেন তাই তার মোট আয়কর থেকে ১২ মাসে ৬০,০০০ তাকা বাদ যাবে।
আর কত আয়কর দিতে হবে?
তার মোট আয়করের পরিমাণ হল ১,৭০,২০০ টাকা। এই টাকা থেকে বাদ যাবে উৎসে কর অর্থাৎ ৬০,০০০ টাকা এবং আয়কর রেয়াত ৫০,২৮০ টাকা। মোট ১,১০,২৮০ টাকা বাদ দিয়ে তাকে আয়কর হিসেবে দিতে হবে ৫৯,৯২০ টাকা।
এই টাকা যখন আয়কর রিটার্ন জমা দেবেন তখন তার সঙ্গে চালান/পে অর্ডার এর মাধ্যমে জমা দিতে হবে।
No comments:
Post a Comment